যে জ্ঞান ফরযে কেফায়া

প্রকাশ থাকে যে, শিক্ষার প্রকারসমূহ উল্লেখ না করা পর্যন্ত কোনটি ফরয এবং কোন্‌টি ফরয নয়- এর পার্থক্য বুঝা যাবে না। 

ফরযে কেফায়ার দিক দিয়ে জ্ঞান দু'রকম- শরীয়তগত ও শরীয়ত বহির্ভূত। 

পয়গম্বরগণের কাছ থেকে যে জ্ঞান অর্জিত হয় এবং বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও শ্রবণ দ্বারা অর্জিত হয় না, তাকে আমরা শরীয়তগত জ্ঞান বলে থাকি। যেমন, অংক শাস্ত্র বুদ্ধি দ্বারা, চিকিৎসা শাস্ত্র অভিজ্ঞতার দ্বারা এবং অভিধান শাস্ত্র শ্রবণের দ্বারা অর্জিত হয়। যে জ্ঞান শরীয়তগত নয়, তা তিন প্রকার- ভাল, মন্দ, অনুমােদিত। যে জ্ঞানের সাথে পার্থিব বিষয়াদির উপযােগিতা জড়িত, তা ভাল জ্ঞান; যেমন চিকিৎসা ও অংক শাস্ত্র! এ শ্রেণীর জ্ঞানের মধ্যে কতক ফরযে কেফায়া এবং কতক শুধু ভাল- ফরয নয়। পার্থিব বিষয়াদিতে যে জ্ঞানের প্রয়ােজন তা ফরযে কেফায়া। যেমন চিকিৎসা শাস্ত্র। দেহের সুস্থতার জন্যে এটা জরুরী। লেনদেন, ওসিয়ত, উত্তরাধিকার বন্টন ইত্যাদিতে অংক শাস্ত্র জরুরী। শহরে কোন ব্যক্তি এ জ্ঞানের অধিকারী না থাকলে শহরবাসীর অসুবিধার অন্ত থাকবে না। কিন্তু অংক শাস্ত্রে একজন জ্ঞানী হলেও যথেষ্ট হয়ে যায় এবং অন্যরা এ ফরয থেকে অব্যাহতি পায়। আমরা চিকিৎসা ও অংক শাস্ত্রের জ্ঞান ফরয বলেছি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এদিক দিয়ে মৌলিক শিল্পগুলােও ফরযে কেফায়া। উদাহরণতঃ বস্ত্র বয়ন, কৃষিকাজ এবং রাজনীতি প্রভৃতিও ফরযে কেফায়া। বদরক্ত চুষে বের করা এবং সেলাই কর্ম শিক্ষা করাও জরুরী। কোন শহরে বদরক্ত বের করার লােক না থাকলে শহরবাসীর জীবন বিপন্ন হবে। যে আল্লাহ রােগ প্রেরণ করেছেন, তিনি ওষুধও নাযিল করেছেন এবং ব্যবহার পদ্ধতিও নির্দেশ করেছেন। এভাবে তিনি রােগমুক্তির উপকরণ ঠিক করে দিয়েছেন। সুতরাং এসব উপকরণ কাজে না লাগিয়ে বিনা চিকিৎসায় মরে যাওয়া বৈধ নয়। যে জ্ঞান ফরয নয়, কেবল ভাল, যেমন অংক ও চিকিৎসার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়সমূহে মননানিবেশ করার প্রয়ােজন হয় না। 

শরীয়ত বহির্ভূত জ্ঞানের মধ্যে মন্দ শিক্ষা, যেমন জাদু ও তেলেসমাতের জ্ঞান, আর অনুমােদিত অর্থাৎ, বৈধ জ্ঞান যেমন, ক্ষতিকর নয় এমন কবিতা এবং ইতিহাসের জ্ঞান। এখানে শরীয়তগত জ্ঞান বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। এ জ্ঞান সবই ভাল। কিন্তু বাস্তবে মন্দ হওয়া সত্ত্বেও তা শরীয়তগত জ্ঞান জানায় ধোকা হয় বিধায় এ জ্ঞান দু'রকম- ভাল ও মন্দ। ভাল জ্ঞানের কিছু অংশ মৌলিক, কিছু অংশ শাখা, কিছু অংশ ভূমিকা এবং কিছু অংশ। পরিশিষ্ট। অর্থাৎ, এ জ্ঞানের চারটি শ্রেণী রয়েছে। প্রথম মৌলিক । এ মৌলিক জ্ঞান চারটি

(১) আল্লাহর কিতাব, (২) রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নত, (৩) উম্মতের ইজমা এবং (৪) সাহাবায়ে কেরামের ঐতিহ্য। ইজমা যেহেতু সুন্নতকে জানার সুযােগ করে দেয়, তাই এটা মৌলিক জ্ঞান। কিন্তু এর মর্যাদা সুন্নতের পর। সাহাবায়ে কেরামের ঐতিহ্যও সুন্নত জ্ঞাপন করে। কারণ, সাহাবায়ে কেরাম ওহী প্রত্যক্ষ করেছেন এবং অবস্থার ইঙ্গিত দ্বারা এমন সব বিষয় দেখেছেন যা অন্যের দৃষ্টিতে অদৃশ্য। তাই আলেমগণ তাঁদের অনুসরণ করা এবং তাঁদের ঐতিহ্যগুলােকে প্রমাণ সাব্যস্ত করা যথার্থ মনে করেছেন।

শরীয়তগত জ্ঞানের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে শাখা, যা এই চারটি মৌলিক জ্ঞান থেকে বুঝা যায়, শব্দাবলী থেকে বুঝা যায় না; বরং অর্থ সম্ভার ও কারণাদির মাধ্যমে হৃদয়ঙ্গম করা যায়। উদাহরণতঃ রসূলে করীম (সাঃ) বলেন ঃ  বিচারক ক্রুদ্ধ অবস্থায় কোন রায় দেবে না। এ থেকে এটাও জানা যায় যে, যখন বিচারকের উপর প্রস্রাবের চাপ থাকে, অথবা সে ক্ষুধার্ত থাকে অথবা রােগ যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে, তখনও রায় দেবে না।

এই শাখা জ্ঞান দু'ভাগে বিভক্ত- (১) পার্থিব কল্যাণ সংক্রান্ত জ্ঞান। কল্যাণের সাথে ফেকাহ এর অন্তর্ভুক্ত। এর দায়িত্বে রয়েছেন ফেকাহবিদগণ। তারা পার্থিব আলেম। (২) আখেরাতের কল্যাণ সম্পর্কিত জ্ঞান হচ্ছে মনের অবস্থা এবং তার ভাল ও মন্দ অভ্যাসের জ্ঞান। এসব অভ্যাসের মধ্যে কোন্‌টি আল্লাহর পছন্দনীয় আর কোটি অপছন্দনীয়, তাও জানতে হয়। এ গ্রন্থের শেষার্ধে এ জ্ঞানের বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।

 শরীয়তগত জ্ঞানের তৃতীয় প্রকার হচ্ছে ভূমিকা, যা শরীয়তগত জ্ঞানের হাতিয়ারস্বরূপ। যেমন, অভিধান ও ব্যাকরণ উভয়টিই কালামে পাক ও হাদীস শরীফের জ্ঞানার্জনের হাতিয়ার। অথচ অভিধান ও ব্যাকরণ শরীয়তগত জ্ঞান নয়। কিন্তু শরীয়ত জানার জন্যে এগুলাে নিয়ে গবেষণা করা অপরিহার্য । কেননা, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শরীয়ত আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। প্রত্যেক শরীয়তের অবস্থা তার ভাষার মাধ্যমে পরিস্ফুট হয় । তাই আরবী অভিধানের জ্ঞানার্জন কালামে পাক ও হাদীস শরীফের জ্ঞানার্জনের জন্য হাতিয়ার সাব্যস্ত হয়েছে। পুথিগত জ্ঞানও এ হাতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এটা জরুরী নয়। কেননা, রসূলুল্লাহ (সাঃ) উম্মী ছিলেন; পুথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। যদি ধরে নেয়া যায়, শ্রুত কথাবার্তা স্মরণ রাখা সম্ভবপর, তবে লেখা শেখার প্রয়ােজন থাকবে না। কিন্তু প্রায়শঃ মানুষ এরূপ হয় না বিধায় অক্ষর জ্ঞান জরুরী।

শরীয়তী জ্ঞানের চতুর্থ প্রকার হচ্ছে পরিশিষ্ট। এটা কোরআন মজীদে রয়েছে। কারণ, এর কতক অংশ শব্দাবলীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন, কেরাত ও অক্ষরের মাখরাজ তথা উচ্চারণস্থল প্রভৃতির জানার্জন। আবার এর কয়েকটি অর্থের সাথে সম্পৃক্ত- যেমন, তফসীর। এ জ্ঞানও কোরআন হাদীসের জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। কেবল অভিধানের জ্ঞান এর জন্যে যথেষ্ট নয়। আরও কতক অংশ কোরআনের বিধি-বিধানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন, নাসেখ, মনসুখ এবং আম ও খাস ইত্যাদির জ্ঞান। এ জ্ঞানকে উসূলে ফেকাহু’ তথা ফেকাহর মূলনীতি বলা হয়। হাদীসও এর অন্তর্ভুক্ত।

হাদীস ও সাহাবীগণের বর্ণনায় রাবীদের নাম, বংশ পরিচয় ও অন্যান্য অবস্থা জানা, সাহাবীদের নাম ও গুণাবলী জানা, যাতে দুর্বল হাদীসকে শক্তিশালী হাদীস থেকে পৃথক করা যায়। রাবীদের বয়সের অবস্থা জানা, যাতে মুরসাল হাদীস মুসনাদ থেকে আলাদা হয়ে যায়। এমনি ধরনের সকল বিষয় পরিশিষ্টের অন্তর্ভুক্ত।

শরীয়তগত জ্ঞানের উপরােক্ত প্রকার চতুষ্টয় কল্যাণকর এবং ফরযে কেফায়া। যদি প্রশ্ন হয়, উপরে ফেকাহ পার্থিব জ্ঞান এবং ফোকাহুবিদগণকে পার্থিব আলেম বলা হল কেন? তবে জওয়াব এই যে, আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম (আঃ)-কে মাটির দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তার সন্তান সন্ততিকে বীর্য দ্বারা সৃষ্টি করে পিতার ঔরস থেকে মাতার গর্ভে এবং সেখান থেকে দুনিয়াতে ভূমিষ্ঠ করেছেন। এরপর দুনিয়া থেকে কবরে, কবর থেকে হিসাব-নিকাশের জন্যে হাশরে এবং সেখান থেকে। জান্নাতে অথবা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। এগুলােই হচ্ছে মানুষের সূচনা এবং শেষ মনযিল ও শেষ পরিণতি। আল্লাহ তা'আলা দুনিয়াকে মানুষের জন্যে আখেরাতের শস্যক্ষেত্র করেছেন, যাতে মানুষ উপার্জনযােগ্য বিষয়সমূহ এখানে উপার্জন করে নেয়। মানুষ যদি সুষ্ঠুভাবে ও ইনসাফ সহকারে দুনিয়াকে গ্রহণ করে, তবে সকল ঝগড়াই চুকে যায়। এবং ফেকাহবিদগণের কোন প্রয়ােজনই অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু মানুষ তা করে না। সে প্রবৃত্তির তাড়নায় তাড়িত হয়ে দুনিয়াকে গ্রহণ করে। ফলে দুনিয়াতে ঝগড়া-বিবাদ ও কলহ সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে রাজা-বাদশাহ তথা শাসনকর্তার প্রয়ােজন দেখা দিয়েছে এবং আইন-কানুন রচনা করতে হয়েছে। ফেকাহবিদ শাসননীতি প্রণয়নে পারদর্শী এবং বিবাদ-বিসংবাদে মানুষের মধ্যে ইনসাফ করার পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। তিনি শাসনকর্তাকে পথ প্রদর্শন করেন। হাঁ, দ্বীনের সাথেও ফেকাহর সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু সরাসরি নয়- দুনিয়ার মধ্যস্থতায়। কারণ, দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতের শস্যক্ষেত্র এবং দ্বীন দুনিয়া ব্যতীত পূর্ণতা লাভ করে না। রাজ্য শাসন ও দ্বীন উভয়েই যমজ অর্থাৎ এক সাথে থাকে। দ্বীন আসল এবং রাজ্য তার রক্ষক। বৃক্ষ যেমন শিকড় ব্যতীত টিকে থাকতে পারে না, দ্বীনও তেমনি রক্ষক ব্যতীত কায়েম ' থাকে না। রাজ্য শাসন ও ব্যবস্থাপনা রাজা ব্যতীত পূর্ণ হয় না।

ঝগড়া-বিবাদ ফয়সালা করার ব্যবস্থা ফেকাহর সাহায্যে হয়ে থাকে। সুতরাং রাজ্য শাসন যেমন প্রথম স্তরের দ্বীনী এলেম নয়; বরং দ্বীনের পূর্ণতায় রাজ্য শাসন সহায়ক হয়ে থাকে, তেমনি রাজ্য শাসন পদ্ধতি অর্থাৎ ফেকাহর জ্ঞানলাভ করাও প্রথম স্তরের দ্বীনী এলেম নয়। উদাহরণতঃ পথিমধ্যে বেদুইনদের কবল থেকে রক্ষা করে- এমন ব্যক্তিকে সাথে না নিয়ে হজ্জ পূর্ণ হয় না। কিন্তু হজ্জ এক বস্তু, হজ্জের পথে চলা দ্বিতীয় বস্তু, হজ্জ পূর্ণ হওয়ার জন্যে পথের নিরাপত্তা তৃতীয় বস্তু এবং এর পদ্ধতি, কৌশল ও আইন-কানুন জানা চতুর্থ বস্তু। রাজ্য শাসন ও হেফাযতের পদ্ধতি শিক্ষা করা ফেকাহর সারকথা। নিম্নোক্ত হাদীসটি এর প্রমাণ ।

আমীর, মামুর ও মুতাকাল্লিফ- এ তিন শ্রেণী ব্যতীত যেন কেউ শাসনকার্য পরিচালনা না করে।
এ হাদীসে ‘আমীর’ বলে ইমাম তথা শাসককে বুঝানো হয়েছে। প্রথম যুগে শাসকই ফতােয়া দিতেন। মামুর' অর্থ ইমামের নায়েব এবং মুতাকাল্লিফ' অর্থ যে আমীরও নয় এবং মামুরও নয়। সে সেই ব্যক্তি, যে স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে এসব পদ গ্রহণ করে। সাহাবায়ে কেরামের রীতি ছিল, তারা ফতােয়া দেয়া থেকে গা বাঁচিয়ে চলতেন এবং একে অপরের উপর ন্যস্ত করতেন। কিন্তু কেউ কোরআন ও আখেরাতের অবস্থা জিজ্ঞেস করলে বলে দিতেন। কতক রেওয়ায়েতে মুতাকাল্লিফ শব্দের স্থলে 'মুরায়ী অর্থাৎ, রিয়াকার বর্ণিত আছে। কারণ, যেব্যক্তি ফতােয়া দানের পদ গ্রহণ করে, অথচ এ কাজের জন্যে একমাত্র সেই নির্দিষ্ট নয়, তার মতলব নাম। যশ ও অর্থোপার্জন ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না বলা যেতে পারে, আপনার এ বক্তব্য হদ্দ ও কেসাসের বিধি-বিধানে এবং ক্ষতিপূরণ ও ঝগড়া-বিবাদের ফয়সালায় জায়েয হতে পারে।

 কিন্তু এ গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত বিষয়বস্তু যেমন- নামায-রােযা ইত্যাদি এবাদত এবং হালাল হারাম কাজ-কারবারের বর্ণনা এ বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করে না। ফেকাহবিদগণ এসব বিষয়েও ফতােয়া দিয়ে থাকেন। এর জওয়াব এই যে, ফেকাহবিদগণ আখেরাতের বিষয়সমূহের মধ্য থেকে যেসব আমল বর্ণনা করেন, সেগুলাে বেশীর চেয়ে বেশী তিন প্রকার হতে পারে- (১) ইসলাম, (২) নামায ও যাকাত এবং (৩) হালাল ও হারাম। কিন্তু এগুলাের মধ্যেও ফেকাহবিদের চূড়ান্ত দৃষ্টি দুনিয়ার সীমা পার হয়ে আখেরাতের দিকে ধাবিত হয় না। এ তিন বিষয়ের অবস্থাই যখন এই, তখন অন্যান্য বিষয়ে তাে দুনিয়ার মধ্যেই থাকবে। উদাহরণতঃ ইসলাম সম্পর্কে ফেকাহবিদ কিছু বললে একথাই বলবে যে, অমুকের ইসলাম সঠিক এবং অমুকের ইসলাম সঠিক নয়। মুসলমান হওয়ার শর্ত এগুলাে কিন্তু এসব বর্ণনায় মুখ ছাড়া অন্য কোন দিকে তার দষ্টি থাকবে না। অন্তর তার রাজত্বের বাইরে। কেননা রসূলুল্লাহ (সাঃ) রাজা বাদশাহদেরকে অন্তরের রাজত্ব থেকে পদচ্যুত করে দিয়েছেন। সেমতে জনৈক সাহাবী এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন যে মুখে ইসলামের কলেমা উচ্চারণ করেছিল। হত্যাকারী রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এই বলে ওযর পেশ করলেন যে, লােকটি তরবারির ভয়ে কলেমা উচ্চারণ করেছিল। রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাকে শাসিয়ে বললেন- তুমি কি তার অন্তর চিরে দেখেছিলে, সে অন্তর দিয়ে বলছে কিনা? বরং ফেকাহবিদ, ইসলাম সঠিক হওয়ার ফতােয়া তরবারির ছায়াতলে দেয়। অথচ সে জানে, তরবারি দ্বারা তার সন্দেহ দূর হয়নি এবং অন্তরের উপর থেকে মূর্খতার পর্দা সরে যায়নি। যদি কোন ব্যক্তির ঘাড়ের উপর তরবারি উত্তোলিত থাকে এবং ধন-সম্পদের দিকে হাত প্রসারিত থাকে, এমতাবস্থায় সে কলেমা উচ্চারণ করলে ফেকাহবিদের ফতােয়া অনুযায়ী তার প্রাণ ও ধন-সম্পদ বেঁচে যাবে। কলেমার দৌলতে তার জীবন ও ধন-সম্পদের ব্যাপারে কেউ আপত্তি করতে পারবে না। এ কারণেই রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ“কলেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” না বলা পর্যন্ত মানুষের সাথে যুদ্ধ করার আদেশ আমাকে দেয়া হয়েছে। যখন তারা এ কলেমা বলবে, তখন আমার কাছ থেকে তারা তাদের জান ও মাল বাঁচিয়ে নেবে।”
এ হাদীসে রসূলুল্লাহ (সাঃ) কেবল জান ও মালের উপর এ মৌখিক কলেমার প্রভাব ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আখেরাতে মৌখিক কথাবার্তা উপকারী নয়; বরং অন্তরের নূর, রহস্য ও চরিত্র উপকারী। এসব বিষয় ফেকাহ শাস্ত্রের অন্তর্গত নয়। কোন ফেকাহুবিদ এগুলাে বর্ণনা করলে তা কালাম ও চিকিৎসা শাস্ত্র বর্ণনা করার মতই হবে। তার এ বর্ণনা ফেকাহ শাস্ত্র বহির্ভূত। 

অনুরূপভাবে যদি কেউ বাহ্যিক সব শর্ত পূরণ করে নামায আদায় করে এবং প্রথম তকবীর ছাড়া সমস্ত নামাযে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গাফেল থাকে; বরং বাজারের কাজকারবারের কথা চিন্তা করতে থাকে, তবে ফেকাহবিদ অবশ্যই ফতােয়া দেবেন যে, তার নামায সঠিক হয়েছে। অথচ এ নামায আখেরাতে তেমন উপকারী হবে না। যেমন, মুখে কেবল কলেমা উচ্চারণ করে নেয়া ইসলামের ব্যাপারে বিচার দিবসে উপকারী। হবে না। কিন্তু ফেকাহবিদ এই অর্থে ইসলাম সঠিক হওয়ার ফতােয়া দেবেন যে, সে যা করছে তাতে আল্লাহর আদেশসূচক বাক্য পালিত হয়ে গেছে এবং হত্যা ও শাস্তি তার উপর থেকে অপসারিত হয়ে গেছে! নামাযে খুশু খুযু, নম্রতা ও অন্তর হাযির করা, যা আখেরাতের কাজ, তা নিয়ে ফেকাহবিদগণ সচরাচর আলােচনা করেন না। করলেও তা ফেকাহ শাস্ত্র থেকে আলাদাই থাকবে।
যাকাতের ব্যাপারেও ফেকাহবিদের দৃষ্টি এতটুকুতেই নিবদ্ধ থাকে, যতটুকু দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে শাসনকর্তার দাবী পূর্ণ হয়ে যায় । অর্থাৎ, এতটুকু হওয়া যে, যদি মালদার ব্যক্তি যাকাত দিতে অস্বীকার করে এবং শাসনকর্তা তাকে জবরদস্তি গ্রেফতার করে, তবে এ ফতােয়া যেন দেয়া যায় যে, তার যিম্মায় যাকাত নেই। বর্ণিত আছে, কাজী আবু ইউসুফ বছরের শেষ ভাগে নিজের ধন-সম্পদ স্ত্রীকে দান করে দিতেন এবং তার ধন-সম্পদ তাকে দিয়ে নিজের নামে দান করিয়ে নিতেন, যাতে যাকাত ওয়াজেব না হয়। এ বিষয়টি কেউ হযরত আবু হানীফা (রহঃ)-এর কাছে বর্ণনা করলে তিনি বললেন ঃ এটা তার ফেকাহর ফল । ইমাম আবু হানীফার এ উক্তি যথার্থ। কেননা, এ কৌশল কেবল দুনিয়াবী ফেকাহরই হতে পারে। পরকালে এর ক্ষতি যেকোন গােনাহ থেকে বড়।

হালাল ও হারামের অবস্থা এই যে, হারাম থেকে আত্মরক্ষা করার স্থির নির্দেশ রয়েছে, কিন্তু হারাম থেকে আত্মরক্ষা করার চারটি স্তর রয়েছে- (১) সেই স্তর, যা সাক্ষীর গ্রহণযােগ্য হওয়ার জন্যে শর্ত। আত্মরক্ষার এ ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ সাক্ষ্য দেয়ার, বিচারক হওয়ার এবং শাসক হওয়ার যােগ্যতা হারিয়ে ফেলে। বাহ্যিক হারাম থেকে বেঁচে থাকাই কেবল এ ধরনের আত্মরক্ষা। (২) সৎকর্মপরায়ণ লােকদের। আত্মরক্ষা; অর্থাৎ এমন সন্দেহজনক বিষয়াদি থেকে আত্মরক্ষা করা, যাতে হারাম ও হালাল হওয়ার উভয়বিধ সম্ভাবনাই বিদ্যমান। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন ঃ “যা সন্দেহজনক নয়, তার বিনিময়ে যা সন্দেহজনক তা ত্যাগ কর।” তিনি আরও বলেন ঃ ; অর্থাৎ, গােনাহ অন্তরে খটকা লাগায়। (৩) মুত্তাকী-পরহেযগারদের আত্মরক্ষা- তারা কিছু সংখ্যক হালালকেও এ কারণে পরিহার করে যে, এর দ্বারা হারাম পর্যন্ত পৌছার ভয় থাকে।

“মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকী হয় না, যে পর্যন্ত এমন বিষয় পরিহার করে, যাতে কোন ক্ষতি নেই ‘ক্ষতি হতে পারে' এমন বিষয়ে জড়িত হওয়ার ভয়ে।" এর উদাহরণ- যেমন, কোন ব্যক্তি গীবত হওয়ার ভয়ে অন্যের অবস্থা বর্ণনা করা থেকে বেঁচে থাকে। অথবা উল্লাস স্ফুর্তি বেড়ে গিয়ে অবাধ্যতা হয়ে যাওয়ার ভয়ে সুস্বাদু খাদ্য ভক্ষণ থেকে বিরত থাকে। (৪) সিদ্দীকগণের আত্মরক্ষা। তা হচ্ছে, আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত সবকিছু থেকে ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, যেন জীবনের এমন কোন মুহূর্ত অতিবাহিত না হয়, যাতে আল্লাহ্ তাআলার নৈকট্য থেকে সামান্য সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদিও তাতে হারাম পর্যন্ত না পৌছার বিষয়টি নিশ্চিতরূপে জানা থাকে।
সুতরাং প্রথম স্তর ব্যতীত সকল স্তরই ফেকাহবিদের দৃষ্টির বাইরে থাকে। তার দৃষ্টি কেবল সাক্ষীদের ও বিচারকদের হারাম থেকে আত্মরক্ষার দিকে থাকে এবং সেসব বিষয়ের দিকে থাকে, যেগুলাে আদেল। হওয়ার পরিপন্থী। এরূপ আত্মরক্ষার উপর কায়েম থাকা আখেরাতে। গােনাহ হওয়ার পরিপন্থী নয়। রসূলুল্লাহ (সাঃ) ওয়াবেসা (রাঃ)-কে বলেন। ঃ “তুমি তােমার অন্তরের কাছ থেকে ফতােয়া নাও, যদিও লােকেরা। তােমাকে ফতােয়া দেয়।”শেষ বাক্যটি তিনি তিন বার উচ্চারণ করেছেন। ফেকাহবিদ অন্তরের খটকার কথা বর্ণনা করে না এবং খটকা সহকারে আমলের অবস্থাও বলে না; বরং কেবল এমন বিষয় বর্ণনা করে, যদ্বারা ব্যক্তির বিশ্বাসযােগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়।
যাবতীয় বক্তব্যের সারমর্ম এই যে, ফেকাহবিদের পূর্ণ দৃষ্টি সে জগতের সাথে জড়িত, যার দ্বারা আখেরাতের পথ নিষ্কন্টক হয়। সে অন্তরের হাল হকিকত ও আখেরাতের বিধানাবলী বললে তা একান্তই প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। যেমন, তার কথায় মাঝে মাঝে চিকিৎসা, অংক, জ্যোতির্বিদ্যা ও কালাম শাস্ত্রের আলােচনাও এসে যায়। এ কারণেই হযরত সুফিয়ান সওরী বলতেন, ফেকাহ শাস্ত্রের অন্বেষণ আখেরাতের পাথেয় নয়। এ উক্তি যথার্থ। কেননা, সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হচ্ছে, তদনুযায়ী আমল করা। এমতাবস্থায় সেই জ্ঞান ব্যবহারিক জীবনের খুঁটিনাটি আইন কানুনের জ্ঞান কিরূপে হতে পারে? এসব বিষয় দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হবে, এ আশায় যে লােক এসব বিষয় শিক্ষা করে সে উন্মাদ। আল্লাহর আনুগত্যে অন্তর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উভয়ের দ্বারা আমল হয়ে থাকে। এ আমলের জ্ঞানই সর্বোত্তম। এখানে প্রশ্ন হয়, আপনি ফেকাহ ও চিকিৎসা শাস্ত্রকে বরাবর করে দিলেন কিরূপে? চিকিৎসা শাস্ত্র দুনিয়া তথা দেহের সুস্থতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর উপরও দ্বীনের সঠিকতা নির্ভরশীল। এরূপ জ্ঞানকে ফেকাহর বরাবর করা ইজমার পরিপন্থী। এর জওয়াব এই যে, চিকিৎসা শাস্ত্র ও ফেকাহ বরাবর হওয়া অপরিহার্য নয়; বরং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। তিনটি কারণে ফেকাহ্ চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর শ্রেষ্ঠ । প্রথমত। ফেকাহ শরীয়তী জ্ঞান অর্থাৎ, নবী (সাঃ)-এর কাছ থেকে অর্জিত। কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্র শরীয়তী জ্ঞান নয়। দ্বিতীয়তঃ যারা আখেরাতের পথিক, তাদের কেউ ফেকাহর প্রতি অমুখাপেক্ষী নয়। রুগ্ন ও সুস্থ উভয়েরই এর প্রয়ােজন রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি কেবল রুগ্নরাই মুখাপেক্ষী। তাদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। তৃতীয়তঃ ফেকাহ শাস্ত্র আখেরাত বিষয়ক শাস্ত্রের সঙ্গী। কারণ, এর সারকথা হচ্ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের প্রতি লক্ষ্য করা। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে অন্তরের অভ্যাস। ভাল আমল ভাল অভ্যাস থেকে প্রকাশ পায় এবং মন্দ আমল মন্দ অভ্যাস থেকে উদগত হয়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যে অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। অপর দিকে সুস্থতা ও অসুস্থতার উৎপত্তি হয় মেযাজ ও পিত্তের দোষ-গুণ থেকে, যা দেহের বিশেষণসমূহের অন্যতম অন্তরের নয়। সুতরাং ফেকাহকে চিকিৎসা শাস্ত্রের সাথে তুলনা করে দেখলে ফেকাহর শ্রেষ্ঠত্ব বুঝা যাবে এবং একে আখেরাত সম্পর্কিত শাস্ত্রের সাথে তুলনা করলে আখেরাত সম্পর্কিত শাস্ত্র মনে হবে।



Comments

Popular posts from this blog

এহইয়াউ উলুমিদ্দীন - প্রথম অধ্যায় - প্রথম পরিচ্ছেদ - জ্ঞান, জানার্জন ও জ্ঞানদানের মাহাত্ম্য

জ্ঞান অন্বেষণের মাহাত্ম (এহইয়াউ উলুমিদ্দীন)

শিক্ষাদানের ফযীলত সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের উক্তি