জ্ঞান অন্বেষণের মাহাত্ম (এহইয়াউ উলুমিদ্দীন)
এ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ নিম্নরূপঃ
“তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লােক কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে?”
“অতএব যারা স্মরণ রাখে, তাদেরকে জিজ্ঞেস কর যদি তােমরা না জানো।
হাদীস নিম্নরূপঃ
* যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণে চলে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথে চালাবেন।”
* ফেরেশতারা জ্ঞান অন্বেষণকারীর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার জন্যে পাখা বিছিয়ে দেয়।
* একশ' রাকআত নফল নামায পড়া অপেক্ষা জ্ঞানের কোন অধ্যায় শিক্ষা করা উত্তম।
* জ্ঞানের কোন অধ্যায় শিক্ষা করা মানুষের জন্যে পৃথিবী ও পৃথিবীস্থিত সবকিছু থেকে উত্তম।
* জ্ঞান অন্বেষণ কর, যদিও তা চীনে থাকে; অর্থাৎ অনেক দূরে থাকে।
* জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয।
* জ্ঞান একটি ভাণ্ডার, যার চাবি হচ্ছে প্রশ্ন করা । সুতরাং জ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়ে প্রশ্ন কর। কেননা, এতে চার ব্যক্তি সওয়াব পায়- (১) প্রশ্নকারী (২) জ্ঞানী ব্যক্তি (৩) শ্রোতা এবং (৪) যে তাদের প্রতি মহব্বত রাখে।
* মূর্খ ব্যক্তি যেন তার মূর্খতা নিয়ে চুপ করে বসে না থাকে । জ্ঞানী ব্যক্তিরও তার জ্ঞান নিয়ে চুপ থাকা উচিত নয়। অর্থাৎ, মূর্খতা দূর করার জন্যে প্রশ্ন করবে এবং জ্ঞানী ব্যক্তি তার জওয়াব দিবে।
* হযরত আবু যরের (রাঃ) হাদীসে বলা হয়েছে ? জ্ঞান সংক্রান্ত মজলিসে হাযির হওয়া হাজার রাকআত নামায পড়া, হাজার রােগীর খবর নিতে যাওয়া এবং হাজার জানাযায় যােগদান অপেক্ষা উত্তম। কেউ আরজ করলঃ কোরআন তেলাওয়াত অপেক্ষাও কি উত্তম? রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন ঃ জ্ঞান ব্যতীত কোরআন কি উপকার করে?
* ইসলামকে জীবিত করার উদ্দেশে জ্ঞান অন্বেষণকালে যেব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, জান্নাতে তার এবং পয়গম্বরগণের স্তর হবে এক।
নিম্নে এ প্রসঙ্গে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের উক্তি বর্ণিত হল ঃ
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ আমি যখন জ্ঞান অর্জন করছিলাম, তখন হীন ছিলাম। এখন আমার কাছে লােকজন জ্ঞান লাভ করতে শুরু করলে সম্মানের অধিকারী হয়ে গেছি।
* ইবনে আবী মুলায়কা বলেন আমি হযরত ইবনে আব্বাসের সমতুল্য কাউকে দেখিনি। তার মুখাকৃতি সর্বোত্তম, কথাবার্তা প্রাঞ্জল এবং ফতােয়া সর্বাধিক জ্ঞানবহ।
* ইবনে মােবারক বলেন ঃ আমার কাছে সেই ব্যক্তি আশ্চর্যজনক, যে জ্ঞান অন্বেষণ করে না। কারণ, তার মন তাকে কোন মাহাত্মের প্রতি আহ্বান করে না।
* জনৈক দার্শনিক বলেন ঃ দু'ব্যক্তির প্রতি আমার মনে যে দয়ার উদ্রেক হয়, তা অন্য কারও প্রতি হয় না- এক, সে ব্যক্তি, যে জ্ঞান অন্বেষণ করে; কিন্তু বুঝে না এবং দুই, সে ব্যক্তি, যে বুঝে; কিন্তু অন্বেষণ। করে না।
* হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেন : একটি মাসআলা শিক্ষা কর। আমার মতে সারা রাত জেগে নফল পড়া অপেক্ষা উত্তম। তিনি আরও বলেন ঃ জ্ঞানী ব্যক্তি এবং জ্ঞান অন্বেষণকারী কল্যাণে অংশীদার। অন্য সকলেই কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। তিনি আরও বলেন ? জ্ঞানী হও অথবা। জ্ঞান অন্বেষণকারী হও অথবা শ্রোতা হও, চতুর্থ কোন কিছু হয়াে না, তা হলে ধ্বংস হয়ে যাবে।
* হযরত আতা (রহঃ) বলেনঃ জ্ঞানের একটি মজলিস ক্রীড়া-কৌতুকের সত্তরটি মজলিসের কাফফারা হয়ে যায়।
* হযরত ওমর (রাঃ) বলেনঃ হাজার রাত জাগরণকারী রােযাদার আবেদের মরে যাওয়া এমন জ্ঞানী ব্যক্তির তুলনায় কম, যে আল্লাহ তা'আলার হালাল ও হারাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ।
* ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেনঃ জ্ঞান অন্বেষণ করা নফলের চেয়ে উত্তম।
* ইবনে আবদুল হাকাম বলেন ঃ আমি ইমাম মালেকের কাছে পাঠাভ্যাসে রত ছিলাম। এমন সময় যােহরের সময় হল। আমি নামাযের জন্যে কিতাব বন্ধ করলে তিনি বললেন : ওহে, যার জন্যে তুমি উঠেছ, সেটা এর চেয়ে উত্তম নয়, যাতে তুমি ছিলে । তবে নিয়ত দুরস্ত হওয়া শর্ত।
হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেন : যেব্যক্তি মনে করে, জ্ঞান অন্বেষণ করা জেহাদ নয়, সে বুদ্ধি বিবেচনায় অপক্ব।
জ্ঞানদানের শ্রেষ্ঠত্ব এ সম্পর্কিত আয়াত এই -
“এবং যাতে সতর্ক করে তাদের সম্প্রদায়কে, যখন তাদের কাছে ফিরে আসে, যাতে সম্প্রদায়ের লােকেরা সংযমী হয়।" . এ আয়াতে সতর্ক করার অর্থ জ্ঞানদান ও পথ প্রদর্শন।
“যখন আল্লাহ কিতাবের অধিকারীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলেন একে মানুষের জন্যে অবশ্যই বর্ণনা করবে এবং গােপন করবে না।”
এতে বলা হয়েছে, জ্ঞানের শিক্ষাদান ওয়াজেব।
“এবং তাদের একটি দল জেনে-শুনে সত্য গােপন করে।”
এতে বর্ণিত হয়েছে যে, জ্ঞান গােপন করা হারাম। যেমন- সাক্ষ্য গােপন করার জন্যে বলা হয়েছে -
যে সাক্ষ্য গােপন করে, তার অন্তর পাপিষ্ঠ।
ومن أحس تو بتن دعا إلى العمل صالحا .
“তার চেয়ে সুন্দর কথা কার, যে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে!”
دع التي سببلي ربك بالحيمة والموعظة الحسنة .
“তােমার পালনকর্তার পথের দিকে আহ্বান কর প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে।"
শিক্ষাদানের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত রয়েছে।
* রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : আল্লাহ তা'আলা কোন জ্ঞানী ব্যক্তিকে জ্ঞানদান করে তার কাছ থেকে সে অঙ্গীকারও নিয়েছেন, যা পয়গম্বরগণের কাছ থেকে নিয়েছেন; অর্থাৎ, তারা অবশ্যই তা বর্ণনা করবে এবং গােপন করবে না।
* রসূলুল্লাহ (সাঃ) মুয়ায ইবনে জাবালকে ইয়ামন প্রেরণ করার সময় বললেন“যদি আল্লাহ তাআলা তােমার দ্বারা একটি লােককেও পথ প্রদর্শন করেন, তবে এটা হবে তােমার জন্যে দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছু অপেক্ষা উত্তম।”
* যেব্যক্তি অন্যদেরকে শিক্ষাদানের উদ্দেশে জ্ঞানের একটি অধ্যায় শিক্ষা করবে, তাকে অবশ্যই পয়গম্বর ও সিদ্দীকের সওয়াব দান করা হবে।
* হযরত ঈসা (আঃ)-এর উক্তি বর্ণিত আছে, যেব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে তদনুযায়ী আমল করে এবং মানুষকে তা শিক্ষাদান করে, সে আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বে মহান বলে বিবেচিত হয়।
* কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা এবাদতকারী ও জেহাদকারীদেরকে বলবেন ? জান্নাতে যাও। আলেম তথা জ্ঞানী ব্যক্তি। বলবেন ? ইলাহী! তারা আমাদের জ্ঞানের বদৌলতে এবাদত ও জেহাদ করেছে; অর্থাৎ সম্মান পাওয়ার যােগ্য আমরা। আল্লাহ তা'আলা বলবেন ? তােমরা আমার কাছে আমার কোন কোন ফেরেশতার সমতুল্য। তােমরা। সুপারিশ কর। তােমাদের সুপারিশ মঞ্জর করা হবে। অতঃপর তারা সুপারিশ করবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ মর্তবা সে জ্ঞানের, যা। শিক্ষাদানের মাধ্যমে অপরের কাছে পৌছায়। সে জ্ঞানের নয়, যা কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যেই সীমিত থাকে এবং অন্যের কাছে পৌঁছায় না।
* রসূলে করীম (সাঃ) এরশাদ করেন
“আল্লাহ তা'আলা মানুষকে জ্ঞান দান করার পর তা ছিনিয়ে নিয়ে যান না। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গকে দুনিয়া থেকে তুলে নেয়ার মাধ্যমে জ্ঞানও তুলে নেন। সেমতে কোন জ্ঞানী ব্যক্তি দুনিয়া থেকে চলে গেলে তার সাথে জ্ঞানও চলে যায়। অবশেষে মূর্খ নেতৃবর্গ ছাড়া কেউ অবশিষ্ট থাকে না। এই মূর্খদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলে তারা না জেনে না শুনে ফতােয়া দেয়। ফলে নিজেরাও বিপথগামী হয় এবং অপরকেও বিপথগামী করে।
যেব্যক্তি কোন জ্ঞান অর্জন করে, অতঃপর তা গােপন করে, আল্লাহ তা'আলা কেয়ামতের দিন তাকে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেবেন।
* উক্তৃষ্ট দান ও উত্তম উপঢৌকন হচ্ছে জ্ঞানের কথা, যা তুমি শুনে স্মরণ রাখবে, এরপর মুসলমান ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাবে এবং তাকে শিক্ষা দেবে। এটা এক বছর এবাদতের সমান।
* বলা হয়েছে - দুনিয়া অভিশপ্ত এবং যা কিছু তাতে রয়েছে, তাও অভিশপ্ত; কিন্তু আল্লাহর যিকির এবং যা এর নিকটবর্তী হয় অথবা শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী, এগুলাে অভিশপ্ত নয়।নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীবৃন্দ, এমনকি পিপীলিকা তাদের গর্তে এবং মৎস্য সমুদ্রে সেই শিক্ষকের জন্যে রহমত কামনা করে, যে মানুষকে কল্যাণ শিক্ষা দেয়।
* এক মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য দোয়ার চাইতে বড় কোন উপকার করতে পারে না।
* যদি ঈমানদার একটি উত্তম কথা শুনে তদনুযায়ী আমল করে, তবে তার জন্যে তা এক বছরের এবাদত অপেক্ষা উত্তম।
* একদিন রসূলুল্লাহ (সাঃ) বাড়ী থেকে বের হয়ে দু'টি মজলিস দেখলেন। এক মজলিসে আল্লাহ তা'আলার কাছে দোয়া প্রার্থনা করা হচ্ছিল এবং মজলিসের লােকেরা দোয়ার প্রতিই উৎসুক ছিল। অপর মজলিসে শিক্ষাদান করা হচ্ছিল । রসূলে করীম (সাঃ) বললেন ঃ প্রথম। মজলিসের লােকেরা তাে আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে দেবেন এবং ইচ্ছা না করলে দেবেন না। কিন্তু দ্বিতীয় মজলিসের লােকেরা শিক্ষাদানে রত আছে। আল্লাহ তা'আলা আমাকেও শিক্ষাদাতারূপেই প্রেরণ করেছেন। এই বলে তিনি দ্বিতীয় মজলিসের দিকে গেলেন এবং তাদের মধ্যে বসে পড়লেন।
* রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ“আল্লাহ তা'আলা আমাকে যে হেদায়েত ও জ্ঞান দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তার দৃষ্টান্ত কোন ভূখন্ডে পতিত প্রচুর বৃষ্টির মত। সে ভূখন্ডের কিছু অংশ এমন যে, সে পানি ধারণ করে এবং প্রচুর ঘাস উৎপন্ন করে। অপর অংশ এমন যে, সে পানি আটকে রাখে। আল্লাহ তা'আলা আটকে পড়া সে পানি দ্বারা মানুষকে উপকার পৌছান। তারা তা পান করে এবং ক্ষেতে সেচ করে। পক্ষান্তরে সে ভূখন্ডের কিছু অংশ এমন যে, সে পানি আটকায় না এবং ঘাস, লতাপাতাও উৎপন্ন করে না।”
এ হাদীসে ভূখন্ডের প্রথম অংশটি তাদের দৃষ্টান্ত, যারা জ্ঞানের দ্বারা নিজেরা উপকৃত হয়। দ্বিতীয় অংশটি তাদের দৃষ্টান্ত, যারা অপরকে উপকার পৌছায় এবং তৃতীয় অংশটি তাদের দৃষ্টান্ত, যারা উভয় বিষয় থেকে বঞ্চিত।
মানুষ মারা গেলে তার কর্ম বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তিনটি বিষয় অব্যাহত থাকে- (১) জ্ঞান- যা দ্বারা অপরের উপকার হয়, (২) সদকায়ে জারিয়া এবং (৩) সকর্মপরায়ণ সন্তান, যে তার জন্যে নেক দোয়া করে।
* সৎ কাজের প্রতি যে উৎসাহ দেয়, সে সকর্মীর অনুরূপ।
* দু'ব্যক্তির প্রতিই ঈর্ষা করা উচিত- (১) যাকে আল্লাহ তা'আলা প্রজ্ঞা দান করেছেন; অতঃপর সে তদনুযায়ী কাজ করে এবং মানুষকে তা শিক্ষা দেয়। (২) যাকে আল্লাহ তা'আলা ঐশ্বর্য দিয়েছেন এবং তা দান-খয়রাতে ব্যয় করতে বাধ্য করেছেন।
* আমার নায়েবদের প্রতি আল্লাহ রহম করুন। লােকেরা জিজ্ঞেস করল ঃ আপনার নায়েব কারা? তিনি বললেন ঃ যারা আমার পথ বেছে নেয় এবং তা মানুষকে শিক্ষা দেয়।
Comments
Post a Comment