এহইয়াউ উলুমিদ্দীন - প্রথম অধ্যায় - প্রথম পরিচ্ছেদ - জ্ঞান, জানার্জন ও জ্ঞানদানের মাহাত্ম্য

 پشيم الله الرحمن الرحيم  



কোরআন মজীদে জ্ঞানের মাহাত্ম্য সম্পর্কিত আয়াতসমূহ এই ঃ 

আল্লাহ তা'আলা বলেন -

ফেরেশতাকুল ও মধ্যপন্থী আলেমগণ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। 

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রথম পর্যায়ে নিজের সত্তা, দ্বিতীয় পর্যায়ে ফেরেশতাকুল এবং তৃতীয় পর্যায়ে জ্ঞানীদের কথা উল্লেখ করেছেন। জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম ও মৌলিকতা বুঝার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট।

আল্লাহ আরও বলেন

যারা বিশ্বাসী এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা তাদের মর্তবা অনেক উঁচু করে দেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন- সাধারণ মুমিনদের মর্তবা অপেক্ষা জ্ঞানী মুমিনদের মর্তবা সাতশ স্তর বেশী হবে এবং প্রত্যেক দুস্তরের দূরত্ব হবে পাঁচশ’ বছরের সমান। আল্লাহ পাক আরও বলেন

 “জিজ্ঞেস করুন, যারা জ্ঞানী এবং জ্ঞানহীন, তারা কি সমান হতে পারে?”

“বান্দাদের মধ্যে একমাত্র আলেমরাই আল্লাহ্ তা'আলাকে ভয় করে।”

"বলে দিন, আল্লাহ এবং কিতাবের জ্ঞানে জ্ঞানীরা আমার ও তােমাদের মধ্যে সাক্ষ্যদাতারূপে যথেষ্ট।"

"যার কাছে কিতাবের জ্ঞান ছিল, সে বললঃ আমি তাকে এনে দিচ্ছি।"

এতে ব্যক্ত করা হয়েছে সে লােকটি জ্ঞানের বলেই রাণী বিলকিসের সিংহাসন এনে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

“যারা জ্ঞানী ছিল, তারা বলল ঃ তােমাদের ধ্বংস হােক, আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণই বিশ্বাসী ও সঙ্কর্মীর জন্য উত্তম।”

এতে বলা হয়েছে, পরকালের মাহাত্ম শিক্ষার মাধ্যমে জানা যায়।

“আমি এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্যে বর্ণনা করি। এগুলাে কেবল তারাই বুঝে, যারা জ্ঞানী।”

“যদি তারা বিষয়টি রসূলের কাছে এবং গণ্যমান্যদের কাছে উপস্থাপন করত, তবে তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানান্বেষী, তারা জেনে নিতে পারত।”
এখানে আল্লাহ তা'আলা পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে তার নিজের বিধান শিক্ষিতদের ইজতিহাদের উপর ন্যস্ত করেছেন। আল্লাহর বিধান জানার ব্যপারে তাদের মাকে পয়গম্বরগণের মর্তবার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন।
“হে বনী আদম! আমি তােমাদের প্রতি নাযিল করেছি পােশাক, যা তােমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে, আর নাযিল করেছি পশম এবং পরহেযগারীসুলভ পােশাক, যা সর্বোত্তম।"
এ আয়াতের ফসীরে কেউ কেউ বলেন এখানে পােশাকের অর্থ শিক্ষা, পশমের অর্থ বিশ্বাস এবং পরহেযগারীসুলভ পােশাক বলে লজ্জা বুঝানাে হয়েছে।
“আমি তাদের কাছে কিতাব পৌছে দিয়েছি, যা জ্ঞান সহকারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছি।”
“আমি সজ্ঞানে তাদের সকল অবস্থা বর্ণনা করব।”
بل هو آيات بينات في صدور الذين أوتوا العلم 
“বরং এগুলাে কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াত, যা জ্ঞানপ্রাপ্তদের বক্ষে • গচ্ছিত।”
“তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে বর্ণনা শিক্ষা দিয়েছেন।” 
এ বিষয়টি অনুগ্রহ প্রকাশের স্থলে বর্ণিত হয়েছে।
জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহ নিম্নরূপঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
من يُرِدِ اللهُ به خيرًا يُفَقِّهه في الدِّينِ ، ويُلْهِمْه 
আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে ধর্মের প্রজ্ঞা দান করেন এবং তার অন্তরে সৎপথ ইলহাম করেন।
তিনি আরও বলেন ঃ 
“জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ পয়গম্বরগণের উত্তরাধিকারী।”
বলাবাহুল্য, নবুওয়তের চেয়ে বড় কোন মর্তবা নেই। কাজেই এ মর্তার উত্তরাধিকারী হওয়ার চেয়ে বড় আর কোন গৌরবও নেই। 
তিনি আরও বলেন ঃ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্যে আকাশ ও পৃখিবীস্থিত সবকিছু মাগফেরাত প্রার্থনা করে।

সুতরাং এর চেয়ে বড় আর কি পদমর্যাদা হবে, যার কারণে আকাশ ও পৃথিবীর ফেরেশতাকুল, মাগফেরাতের দোয়ায় মশগুল থাকবে? জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের মধ্যে ব্যাপৃত থাকে, আর ফেরেশতারা তার জন্যে মাগফেরাত প্রার্থনায় নিরত থাকেন। 

রসূলে করীম (সঃ) বলেনঃ “প্রজ্ঞা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির মাহাত্ম্য বৃদ্ধি করে এবং গােলামের মর্যাদাও এত উঁচু করে যে, তাকে রাজা-বাদশাহদের আসনে বসিয়ে দেয়।” 
এ হাদীসে তিনি দুনিয়াতে জ্ঞানের ফলাফল বর্ণনা করেছেন। বলাবাহুল্য, আখেরাত দুনিয়ার তুলনায় শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী।
এক হাদীসে বলা হয়েছে 
خصلتان لا تکونان فی منافق؛ حسن سمت و فقه فی الدّین.
“দুটি স্বভাব মােনাফেকের মধ্যে পাওয়া যায় না। -(১) সুন্দর পথ প্রদর্শন এবং (২) ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞান।" কোন কোন সমসাময়িক ধর্ম জ্ঞানীর নেফাক (কপটতা) দেখে এ হাদীস সম্পর্কে সন্দেহ করা উচিত নয়। কেননা, “ফেকাহ্" শব্দ বলে রসূলুল্লাহ (সঃ) সে জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই বুঝাননি, যা তােমরা মনে কর; বরং এ শব্দের অর্থ পরে বর্ণিত হবে। 

ফেকাহবিদের সর্বনিম্ন স্তর হল আখেরাতকে দুনিয়া অপেক্ষা উত্তম বলে বিশ্বাস করা। এ বিশ্বাস ফেকাহবিদের মধ্যে সুষ্ঠু ও প্রবল হয়ে গেলে সে নেফাক ও নাম-যশের মােহ থেকে মুক্ত হয়ে যায়। রসূলুল্লাহ (সঃ) আরও বলেনঃ “মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও ঈমানদার সেই জ্ঞানী ব্যক্তি, যার কাছে মানুষ প্রয়ােজন নিয়ে আগমন করলে সে তাদের উপকার করে এবং মানুষ তার প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করলে সে নিজেকে বিমুখ করে দেয়।" 
তিনি আরও বলেছেন : “ঈমান নিরাভরণ । তার পােশাক হচ্ছে তাকওয়া (খােদাভীতি), তার মজ্জা হচ্ছে লজ্জা এবং তার ফল হচ্ছে জ্ঞান।" 
এক হাদীসে আছে - মানুষের মধ্যে নবুওয়তের মর্তবার নিকটতম হচ্ছে জ্ঞানী ও জেহাদকারী সম্প্রদায়। জ্ঞানী সম্প্রদায় এ কারণে যে, তারা মানুষকে রসূলুল্লাহ (সঃ) কতৃর্ক আনীত কথাবার্তা বলে এবং জেহাদকারীগণ এ কারণে যে, তারা পয়গম্বরগণের আনীত শরীয়তের জন্যে অশ্বের সাহায্যে জেহাদ করে। 
অন্য এক হাদীসে আছে : “একটি গােষ্ঠীর মরে যাওয়া একজন জ্ঞানী ব্যক্তির মরে যাওয়া অপেক্ষা সহজতর ।"
রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
“মানুষ স্বর্ণ ও রৌপ্যের খনির মত খনি বিশেষ। অতএব যারা জাহেলিয়াতের যুগে শ্রেষ্ঠ ছিল, তারা ইসলাম যুগেও শ্রেষ্ঠ, যদি তারা দ্বীনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়।" 
এক হাদীসে আছেঃ “কেয়ামতের দিন জ্ঞানীদের লেখার কালি শহীদদের রক্তের সাথে ওজন করা হবে।” আরও আছে ঃ “আমার উম্মতের যেব্যক্তি চল্লিশটি হাদীছ মুখস্থ করবে, সে কিয়ামতের দিন ফেকাহবিদ ও জ্ঞানীরূপে আল্লাহ তা'আলার সাক্ষাৎ লাভ করবে।" 
অন্যত্র আছে ঃ যেব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করবে, আল্লাহ তাকে দুঃখ থেকে বাঁচাবেন এবং তাকে ধারণাতীত জায়গা থেকে জীবনােপকরণ সরবরাহ করবেন।” 
আরও বলা হয়েছে - আল্লাহ তা'আলা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রতি এই মর্মে ওহী পাঠালেন, “হে ইবরাহীম! আমি মহাজ্ঞানী এবং প্রত্যেক জ্ঞানীকে পছন্দ করি।” 
আরও আছে ঃ “আমার উম্মতের মধ্যে দুই শ্রেণীর লােক রয়েছে, যারা ঠিক হয়ে গেলে সকল মানুষ ঠিক হয়ে যায় এবং যারা বিগড়ে গেলে সকল মানুষ বিগড়ে যায়। তাদের এক শ্রেণী হচ্ছে শাসক এবং অপর শ্রেণী ফেকাহবিদ অর্থাৎ, দ্বীনী এলমে সমৃদ্ধ ব্যক্তিবর্গ।" 
অন্য হাদীসে আছেঃ “আল্লাহর নৈকট্যশালী করে এমন জ্ঞান বেশী পরিমাণে না থাকার দিন যদি আমার উপর আসে, তবে সেদিনের সূর্যোদয় যেন আমার ভাগ্যে না জুটে।”
এবাদত ও শাহাদতের উপর জ্ঞানীকে শ্রেষ্ঠত্বদান প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন -
“জ্ঞানী ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব এবাদতকারীর উপর এমনি, যেমন আমার শ্রেষ্ঠত্ব সাহাবীদের উপর।”
লক্ষণীয়, এ হাদীসে রসূলুল্লাহ (সাঃ) এলেমকে কেমন করে নবুওয়তের স্তরে রেখেছেন এবং জ্ঞানহীন কর্মের মর্তবা কেমন করে হ্রাস করেছেন। অথচ এবাদতকারী সদাসর্বদা যে এবাদত করে, তার জ্ঞান সে অবশ্যই রাখে। এ জ্ঞান না হলে এবাদত হবে না।
রসূলে করীম (সাঃ) বলেছেনঃ
“আলেম ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব এবাদতকারীর উপর তেমনি, যেমন চতুর্দশীর চাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব তারকারাজির উপর হয়ে থাকে।”
তিনি আরও বলেছেনঃ
يشفع يوم القيامة ثلاثة الأنبياء ثم العلماء ثم الشهداء 
“কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লােক সুপারিশ করবে- পয়গম্বরগণ, অতঃপর জ্ঞানী লােকগণ, অতঃপর শহীদগণ।"
এ হাদীস দ্বারা জ্ঞানের এমন মাহাত্ম্য প্রমাণিত হয় যে, এটা নবুওয়তের পরে এবং শাহাদতের অয়ে। অথচ শাহাদতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বহু রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে । রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আরও বলেছেন : “আল্লাহ্ তা'আলার এবাদত কোন কিছুর মাধ্যমে ততটুকু সমৃদ্ধ হয় না, যতটুকু দ্বীনের জ্ঞানের মাধ্যমে হয়। একজন দ্বীনের জ্ঞানী ব্যক্তি শয়তানের জন্যে হাজার এবাদতকারী অপেক্ষা কঠোর হয়ে থাকে। প্রত্যেক বস্তুর একটি স্তম্ভ আছে। এ দ্বীনের স্তম্ভ হচ্ছে ফেকাহ (দ্বীনী জ্ঞান)।” আরও বলা হয়েছে। ৪ “ঈমানদার আলেম ঈমানদার আবেদ অপেক্ষা সত্তর গুণ শ্রেষ্ঠ ।" অন্য। এক হাদীসে আছেঃ “তােমরা এমন যুগে রয়েছ, যখন জ্ঞানী ব্যক্তির সংখ্যা অনেক এবং বক্তার সংখ্যা কম। ভিক্ষুকের সংখ্যা অল্প এবং দাতার সংখ্যা অধিক। এমন যুগে জ্ঞান লাভ করা অপেক্ষা আমল করা উত্তম। অতি সতুর এমন যুগ আসবে, যখন জ্ঞানীর সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং বক্তা হবে অধিক। দাতা কম হবে এবং ভিক্ষুক বেশী হবে। তখন জ্ঞান অর্জন হবে আমল অপেক্ষা উত্তম।” রসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেছেনঃ “জ্ঞানী ব্যক্তি ও এবাদতকারীর মধ্যে একশ’ স্তরের ব্যবধান রয়েছে। প্রত্যেক দু'স্তরের মাঝখানে এতটুকু দূরতু রয়েছে, যতটুকু একটি দ্রুতগামী ঘােড়া। সত্তর বছরে অতিক্রম করতে পারবে।” এক হাদীসে বর্ণিত আছে, সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন : “ইয়া রসূলাল্লাহ, কোন্ আমলটি উত্তম?” তিনি বললেনঃ আল্লাহ পাক সম্পর্কিত জ্ঞান। সাহাবীগণ আরজ করলেন ঃ আমরা উত্তম আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি। তিনি বললেনঃ আল্লাহ পাক সম্পর্কিত জ্ঞান। আবার বলা হলঃ আমরা আমল সম্পর্কে প্রশ্ন করছি, আপনি এলেম সম্পর্কে বলছেন! তিনি বললেনঃ এলেমের সমন্বয়ে অল্প আমল উপকারী হয় এবং মুখতার সমন্বয়ে অধিক আমলও নিষ্ফল হয়ে যায় ।" এক হাদীসে আছে । কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা বান্দাদেরকে উঠাবেন। অতঃপর আলেমদেরকে উঠাবেন এবং তাদেরকে বলবেন ঃ “হে জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ! আমি তােমাদের মধ্যে যে জ্ঞান। রেখেছিলাম, তা তােমাদেরকে কিছু জেনেই রেখেছিলাম। আমি তােমাদের মধ্যে আমার জ্ঞান এজন্যে রাখিনি যে, তােমাদেরকে শাস্তি দেব। যাও, আমি তােমাদেরকে ক্ষমা করলাম।” আল্লাহ তা'আলার কাছে আমরাও এমনি আনজাম কামনা করি।
জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীগণেরও অনেক উক্তি বর্ণিত আছে। হযরত আলী (রাঃ) কোমায়লকে বললেন, “হে কোমায়ল! জ্ঞান ধন-সম্পদ অপেক্ষা উত্তম। জ্ঞান তােমার হেফাযত করে, আর তুমি ধন-সম্পদের হেফাযত কর। জ্ঞান শাসক আর ধন-সম্পদ শাসিত। ধন ব্যয় করলে হ্রাস পায় আর জ্ঞান ব্যয় করলে বেড়ে যায়। তিনি আরও বলেন ঃ “জ্ঞানী ব্যক্তি রােযাদার, এবাদতকারী ও জেহাদকারী অপেক্ষা উত্তম । আলেম ব্যক্তির মৃত্যু হলে ইসলামে এমন শূন্যতা দেখা দেয়, যা তার উত্তরসুরি ছাড়া কেউ পূরণ করতে পারে না। তার কথিত একটি আরবী কবিতার অনুবাদ এরূপ ।
"সকল মানুষ আকার-আকৃতিতে একরূপ। সকলের পিতা আদম এবং সকলের মা হওয়া। তারা যদি মূল উপাদান নিয়ে গর্ব করতে চায়, তবে পানি ও মৃত্তিকা ব্যতীত তাদের মূল উপাদান আর কি? হাঁ, যার দেহে আলেমদের গর্বের আলখেল্লা আঁটা রয়েছে। কেননা, সে নিজে যেমন পথপ্রাপ্ত, তেমনি অপরেরও পথ-প্রদর্শক। সৌন্দর্যের বস্তু তার অর্জিত রয়েছে। এটাই মানুষের মর্যাদা। মূখরা সদা জ্ঞানীদের সাথে শত্রুত। পােষণ করে। তথাপি তুমি এমন জ্ঞান অর্জন কর, যদ্বারা চিরঞ্জীব হতে পার। সকল মানুষ মৃত; কিন্তু জ্ঞানী চিরজীবী।
আবুল আসওয়াদ (রহঃ) বলেন : জ্ঞানের চেয়ে বেশী ইযযতের কোন বিষয় নেই। বাদশাহ জনগণের শাসক হয়ে থাকে এবং জ্ঞানীরা বাদশাহদের শাসক হয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ হযরত সােলায়মান ইবনে দাউদ (আঃ)-কে এলেম, ধন-সম্পদ ও রাজত্বের মধ্য থেকে যে কোন একটি বেছে নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। তিনি এলেম পছন্দ করেছিলেন। ফলে তাঁকে এলেমের সাথে ধন এবং রাজতুও দান করা হয়েছিল। হযরত ইবনে মােবারক (রহঃ)-কে কেউ জিজ্ঞেস করল । মানুষ কে? তিনি বললেন ঃ সংসারবিমুখ দরবেশ। প্রশ্ন হল ঃ নীচ কে? উত্তর হল ঃ “যারা নিজেদের দ্বীন বিক্রি করে খায়। মােট কথা, জ্ঞানী ব্যক্তি ছাড়া অন্য কাউকে তিনি মানুষ বলেননি। কেননা, যে বৈশিষ্ট্য মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে পার্থক্য সূচিত করে, তা হচ্ছে জ্ঞান। মানুষ তখনই মানুষ বলে কথিত হবে যখন তার মধ্যে গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণ দিব্যমান থাকবে। মানুষের মর্যাদা দৈহিক শক্তির কারণে নয়। কেননা, উট তার চেয়ে বেশী শক্তির অধিকারী। মানুষের মর্যাদা বিশাল বপু হওয়ার কারণেও নয়। কেননা, হাতীর বপু তার চেয়ে অনেক বিশাল। তেমনি বীরত্বের কারণেও নয়। কেননা, হিংস্র জন্তুর বীরত্ব মানুষের  চেয়ে বড়। বরং একমাত্র জ্ঞানের দিক দিয়েই মানুষ সম্ভ্রান্ত। জ্ঞানের জন্যই মানুষ সৃষ্টি। জনৈক দার্শনিক বলেন ঃ কেউ আমাকে বলুক, যেব্যক্তি এলেম পায়নি, সে কি পেয়েছে এবং যেব্যক্তি এলেম পেয়েছে, তার পাওয়ার আর কি বাকী আছে?
| ফাতাহ মুসেলী বলেন ঃ রােগীকে রােজ রােজ খাদ্য, পানীয় ও ওষুধপত্র কিছু না দিলে সে কি মরে যাবে না? লােকেরা বলল ঃ নিঃসন্দেহে মরে যাবে। তিনি বললেন ও আত্মার অবস্থাও দ্রুপ। আত্মাকে তিন দিন এলেম ও জ্ঞান থেকে উপােস রাখলে সে মরে যায়। তাঁর এ উক্তি যথার্থ। কেননা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হচ্ছে আত্মার খােরাক; এগুলাের মাধ্যমেই তার জীবন; যেমন দেহের খােরাক খাদ্য। যার জ্ঞান নেই, তার অন্তর রুগ্ন। মৃত্যু তার জন্যে অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার আত্মার রােগ ও মৃত্যুর খবর রাখে না। দুনিয়ার মহব্বত ও কাজ কারবারে লেগে থাকার। কারণে তার চেতনা লােপ পায়। যেমন ভয় ও নেশার আতিশয্যে জখমের। ব্যথা অনুভূত হয় না; যদিও বাস্তবে ব্যথা থাকে। কিন্তু মৃত্যু যখন দুনিয়ার বােঝা ও সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়, তখন সে আত্মার মৃত্যুর কথা জানতে পারে এবং পরিতাপ করে। অবশ্য তখন পরিতাপে কোন উপকার হয় না। ভীত ব্যক্তির ভয় অথবা মাতালের নেশা দূর হয়ে গেলে ভয় ও নেশার অবস্থায় তার যেসব জখম লাগে, সেগুলাে সে হাড়ে হাড়ে টের পেতে থাকে। সত্য উদঘাটিত হওয়ার সেই দিনের ভয়াবহতা থেকে আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। কেননা, এখন মানুষ ঘুমিয়ে আছে। মৃত্যু হলে জাগ্রত হবে।
হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন : “জ্ঞানী লােকদের লেখার কালি। এবং শহীদদের রক্ত ওজন করা হলে কালির ওজন বেশী হবে।” হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) বলেনঃ “হে লােকসকল! জ্ঞান অর্জন কর জ্ঞানকে তুলে নেয়ার পূর্বে। জ্ঞান তুলে নেয়ার অর্থ জ্ঞানী লােকদের মৃত্যুবরণ করা। আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ- যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে, তারা জ্ঞানী লােকদের মাহাত্ম্য দেখে আকাঙক্ষা করবে যে, আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে জ্ঞানী অবস্থায় পুনরুত্থিত করলেই ভাল হত। কেউ জ্ঞানী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না, বরং অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জিত। 
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন ঃ রাতের কিছু অংশে জ্ঞানচর্চা করা আমার মতে সারারাত জাগ্রত থেকে নফল এবাদত করা অপেক্ষা উত্তম। এ বিষয়টিই হযরত আবু হােরায়রা (রাঃ) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) থেকেও বর্ণিত আছে।
“আয় পরওয়ারদেগার! আমাদেরকে ইহকালে পুণ্য এবং পরকালে পুণ্য দান করুন।"
এ আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেনঃ দুনিয়ার পুণ্য জ্ঞান ও আরাধনা। পরকালের পুণ্যের অর্থ জান্নাত।
জনৈক দার্শনিককে কেউ প্রশ্ন করল ? কোন বস্তু সঞ্চয় করা দরকার? উত্তর হল ? এমন বস্তু সঞ্চয় করা উচিত, যা তােমার নৌকা ডুবে গেলে তােমার সাথে সাঁতার কাটতে থাকে। অর্থাৎ, জ্ঞানই হচ্ছে সঞ্চয়যােগ্য বস্তু। কারণ, দেহরূপী নৌকা মৃত্যুরূপী সলিলে সমাধিলাভ করলে পর এটাই সাথে থাকে।
অন্য একজন দার্শনিক বলেন ঃ “যেব্যক্তি প্রজ্ঞাকে নিজের লাগাম বানিয়ে নেয়, মানুষ তাকে ইমাম করে নেয়। যেব্যক্তি জ্ঞানে খ্যাতি অর্জন করে, মানুষ তাকে ইযযত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে।”
ইমাম শাফেয়ী বলেন ঃ জ্ঞানের এক গৌরব এই যে, “একে কোন ব্যক্তির সাথে সামান্যতম ব্যাপারেও সম্পর্কযুক্ত করা হলে সে আনন্দিত হয়। উদাহরণতঃ যদি বলা হয়, অমুক ব্যক্তি এ ব্যাপারে জ্ঞান রাখে, তবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আনন্দ অনুভব করে। পক্ষান্তরে সে এ বিষয়ের জ্ঞান রাখে - একথা কাউকে বলা হলে সে দুঃখিত হয়।”
হযরত ওমর (রাঃ) বলেনঃ “হে লােকসকল! জ্ঞানব্ৰতী হও। আল্লাহ তা'আলার কাছে একটি মহব্বতের চাদর আছে। যেব্যক্তি কোন বিষয়ের জ্ঞান অন্বেষণ করে, আল্লাহ তাআলা সে চাদর তাকে পরিয়ে দেন। এরপর সে ব্যক্তি কোন গােনাহ করলেও তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের তওফীক দান করা হয়। পুনরায় গােনাহ করলেও আল্লাহ তাকে এই তওফীক দান করেন। তৃতীয় বার গােনাহ্ করার পরও এরূপ করা হয়। এভাবে বার বার তওফীক দানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তার কাছ থেকে সে চাদরটি ছিনিয়ে না নেয়া, যদিও তার গােনাহ বৃদ্ধি পেতে পেতে মৃত্যু পর্যন্ত পৌছে।”
আহনাফ (রহঃ) বলেন, “মনে হয় জ্ঞানীগণ সমগ্র ইজ্জতের মালিক হয়ে যাবে। যে ইজ্জত জ্ঞানের দ্বারা সুদৃঢ় না হয়, তার পরিণতি হয় লাঞ্ছনা ।”
সালেম ইবনে আবী জা'দ বলেনঃ “আমি ক্রীতদাস ছিলাম। প্রভু আমাকে তিন'শ দেরহামের বিনিময়ে মুক্ত করে দিলে আমি কি কাজ শিখে জীবিকা নির্বাহ করব সে সম্পর্কে ভাবতে লাগলাম। অবশেষে, জ্ঞানকে পেশা করে নিলাম। এরপর এক বছর অতীত না হতেই শহরের শাসক আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। আমি তাকে ফিরিয়ে দিলাম; কাছে আসতে দিলাম না।”
যুহরা ইবনে আবু বকর বলেন ঃ আমার পিতা আমাকে ইরাকে জ্ঞান ব্রতী হতে চিঠি লেখলেন। তিনি লেখলেন- যদি তুমি নিঃস্ব হয়ে যাও। তবে জ্ঞান হবে তােমার ধন। আর যদি ধনাঢ্য হয়ে যাও, তবে জ্ঞান হবে অঙ্গসজ্জা।
|হযরত লােকমান তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিলেনঃ হে বৎস! জ্ঞানীদের কাছে বস। কেননা, আল্লাহ তা'আলা জ্ঞানের নূর দ্বারা অন্তরকে জীবিত করেন, যেমন বৃষ্টির পানি দ্বারা মাটিকে শস্যশ্যামল করেন। জনৈক দার্শনিক বলেন ঃ জ্ঞানী ব্যক্তি মারা গেলে তার জন্যে পানিতে মাছ এবং শূন্যে পাখীরা পর্যন্ত ক্রন্দন করে। বাহ্যতঃ তাঁকে দেখা না গেলেও তাঁর স্মৃতি অন্তরে জাগ্রত থাকে।

Comments

Popular posts from this blog

জ্ঞান অন্বেষণের মাহাত্ম (এহইয়াউ উলুমিদ্দীন)

শিক্ষাদানের ফযীলত সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের উক্তি